দুর্নীতিবাজদের অর্থ যেভাবে রোহিঙ্গাদের কল্যাণে বরাদ্দ হতে পারে

অনলাইন ডেস্ক – জব্দকৃত অর্থ শরণার্থীদের কল্যাণে ব্যয়ের পরামর্শ দিতে গিয়ে সুইজারল্যান্ডকে মডেল হিসেবে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব শরণার্থী পরিষদ (ওয়ার্ল্ড রিফিউজি কাউন্সিল)। বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে সুইজারল্যান্ডের নীতির আলোকে দেখানো হয়েছে, বিশ্বজুড়ে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের জব্দকৃত অর্থ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মতো বাস্তুচ্যুতদের জন্য কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে শরণার্থী সংকট সৃষ্টিকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় অর্থ জব্দ করে তা বাস্তুচ্যুতদের কল্যাণে ব্যয় করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে বাস্তচ্যুত করা মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮৫ লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সর্বোচ্চ সংখ্যা এটি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তহবিল মূলত স্বেচ্ছা অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি সতর্ক করেছেন, তাদের তহবিল ফুরিয়ে আসছে। ‘ওয়ার্ল্ড রিফিউজি কাউন্সিল’ ‘অ্যা কল টু অ্যাকশন: ট্রান্সফর্মিং দ্য গ্লোবাল রিফিউজি সিস্টেম’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের জব্দকৃত অর্থ এবং সংকট সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের সম্পদ জব্দ করে সেই অর্থ আইনগতভাবে শরণার্থীদের কল্যাণে ব্যয়ের মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ দেখিয়েছে।

বিশ্ব শরণার্থী পরিষদের সভাপতি অ্যাক্সওয়ার্থি বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা মূলত এমনভাবে প্রস্তাব দিয়েছি, যেন সবাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে শরণার্থী ইস্যুকে মানবিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে।’ বিশ্বের ২ কোটি ৫৪ লাখ শরণার্থী ও ৪ কোটি অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ও ৩১ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশীর নিরাপত্তা, উন্নয়ন, মানবাধিকার নিশ্চিতের জন্য অর্থায়ন প্রয়োজন। অ্যাক্সওয়ার্থি বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দাবি করেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের চুরি করা বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে জব্দকৃত অবস্থায় ব্যাংকে রয়েছে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার কোটি ডলার।

২০১৪ সালে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘স্টোলেন মানি রিকভারি ইনিশিয়েটিভের’ (স্টার) যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘ফিউ অ্যান্ড ফার: দ্য হার্ড ফ্যাক্ট অব স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন। ২০১০-২০১২ মেয়াদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতা-কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে দুই হাজার থেকে চার হাজার কোটি ডলার । তখন পর্যন্ত এমন অর্থের মধ্যে জব্দ করা সম্ভব হয়েছিল ১৩৯ কোটি ডলার। ওই একই মেয়াদকালে করা হিসেব মতে, জব্দ অর্থের মাত্র ১৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার ফেরত দেওয়া হয়েছিল।

অ্যাক্সওয়ার্থি প্রস্তাব দিয়েছেন, বিভিন্ন দেশের সংসদে আইন পাসের মধ্য দিয়ে এ অর্থ শরণার্থীদের কল্যাণে ব্যায়ের স্বার্থে পুনর্বণ্টনের পথ তৈরির। তবে কতগুলো দেশ আইন পাস করেজব্দ করা অর্থ পুনর্বণ্টন করার এখতিয়ার আদালতকে দেবে তার ওপর নির্ভর করছে বিষয়টির বাস্তবায়ন। সুইজারল্যান্ড তা করতে পেরেছে উল্লেখ করে, দেশটিকে মডেল হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অ্যাক্সওয়ার্থি।

দীর্ঘদিন ধরে সুইজারল্যান্ডের পরিচিতি ছিল অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে। তারপরও গত ৩০ বছরে দেশটির সরকার পিইপি (পলিটিকালি এক্সপোসড পার্সনস) নামে আখ্যায়িত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের অর্থ জব্দ করা ও তা অন্যখাতে বরাদ্দের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে। আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড তার ‘নিরাপদ’ ব্যাংকগুলোতে পিইপিদের গচ্ছিত রাখা প্রায় ২০০ কোটি ডলার ফিরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের আর কোনও আর্থিক কেন্দ্র এই পরিমাণ অর্থ ফেরত দেয়নি।

যেসব একনায়ক এবং দুর্নীতিবাজদের গচ্ছিত অর্থ এখন পর্যন্ত ফেরত দিয়েছে সুইজারল্যান্ড তাদের মধ্যে রয়েছে, ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ ম্যাক্রো, পেরুর ভ্লাদিমিরো মন্টেসিনো, সাবেক জায়ারের মোবুতু সেসে সেকো, অ্যাঙ্গোলার জোসে অ্যাদুয়ার্দো দস সান্তোস, নাইজেরিয়ার সানি আবাচা, কাজাখাস্তানের কয়েকজন কর্মকর্তা, মেক্সিকোর রাউল সালিনা, হাইতির জিন ক্লদ ডুভালি, তিউনিসিয়ার জিনে এল আবিদিন বেন আলি এবং মিসরের হোসনি মোবারক। এমন প্রক্রিয়া চালু থাকার পরও ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ড পিইপিদের গচ্ছিত রাখা অর্থ জব্দ করা এবং তা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে নতুন আইন পাস করে। এতে আগে থেকেই কার্যকর থাকা নজরদারি প্রক্রিয়াটি আরও বেশি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়।

বিশ্ব শরণার্থী পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়, শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া মানুষদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। বিশ্বে তারাই সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। শরণার্থী নারী ও শিশুদের জব্দ করা অর্থ ব্যবহার করে বেশি সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে। কোনও দেশ যদি রাজনৈতিক কারণে শরণার্থীদেরকে পুনর্বাসিত করতে না চায় তাহলে শরণার্থীদের খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া সংশ্লিষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সেইসব দেশের অর্থ পুনর্বণ্টন করারও প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্ব শরণার্থী পরিষদ।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফেন ওসলার হ্যাম্পসন ভাষ্য থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ভেনেজুয়েলার জব্দ হওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০০ কোটি ডলার রয়েছে। লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পরিবারের লাখ লাখ ডলার অর্থ বাজেয়াপ্ত অবস্থায় আছে। আর নাইরোবিতে বাজেয়াপ্ত অবস্থায় রয়েছে দক্ষিণ সুদানের সেনা কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ।

জব্দ করা অর্থ দিয়ে কী কী করা যেতে পারে তার প্রমাণ হাজির করা হয়েছে কজাখাস্তানের উদাহরণ টেনে। সেখানকার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গচ্ছিত রাখা অর্থ সুইজারল্যান্ডে জব্দ করা হলে এই অর্থের মালিকানার দাবি নিয়ে সামনে যায় কাজাখাস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড। পরে তিন দেশ একমত হয়, জব্দ করা অর্থ একটি ট্রাস্ট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে খরচ করা হবে, যাতে কাজাখাস্থানের শিশুদের কল্যাণে তা ব্যয় করা যায়। ফিরিয়ে দেওয়া অর্থ কীভাবে খরচ হচ্ছে তা নজরে রাখতে কাজ করতে থাকে একটি নতুন গড়ে তোলা ফাউন্ডেশন। আর এর মাধ্যমে কাজাখাস্তান বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে ফেরত পেতে থাকে অর্থ। এই অর্থ দিয়ে কাজাখাস্তানের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বৃত্তি প্রদান এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে নেওয়া পদক্ষেপের বাস্তবায়ন করা হয়। অর্থ ফেরত পেতে কাজাখাস্তান সরকারকে পূরণ করতে হয় দুর্নীতি দমনে সংস্কার কর্মসূচি। আর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ফেরত দিতে থাকা অর্থের বিষয়টি তদারকি করে বিশ্বব্যাংক।  

বিশ্ব শরণার্থী পরিষদের সভাপতি অ্যাক্সওয়ার্থি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও টেনে আনেন। তিনি মনে করেন, বড় ধরনের বাস্তুচ্যুতির জন্য মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা দায়ী। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করলে বাস্তুচ্যুতির জন্য দায়ীদের ‘দায়মুক্তি পাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিরোধ’ করা সম্ভব হবে। শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদে নতুন ধারা যুক্ত করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড রিফিউজি কাউন্সিল’ মনে করে, যেসব দেশ নাগরিকদের বাস্তচ্যুত করে, তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর অর্থ জব্দ করে তা সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে ব্যয় করা হতে পারে এসব আর্থিক শাস্তির মধ্যে অন্যতম।

আরও খবর